ভূমিকা

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিস মহামারী হিসেবে দেখা দিয়েছে। রোগের ব্যাপকতা উপলব্ধি করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৯৭ সালে ডায়াবেটিসকে মহামারী হিসেবে ঘোষণা করে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, ২০১৪ সালে পৃথিবীতে মোট ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ৩৮.২ কোটির বেশি, যা ২০৩৫ সালে গিয়ে দাঁড়াবে ৪৭.১ কোটিতে। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, উন্নত বিশ্বের দেশগুলির তুলনায় বর্তমানে বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশগুলিতে ডায়াবেটিস বৃদ্ধির হার অনেক বেশি। ২০২৫ সাল নাগাদ উন্নত বিশ্বের দেশগুলিতে যেখানে ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা বাড়বে প্রায় ৪২ শতাংশ হারে, সেখানে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে বৃদ্ধির এই হার গিয়ে দাঁড়াবে ১৭০ শতাংশে। 


পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও অসংক্রামক রোগসমূহ বিশেষ করে, ডায়াবেটিস দ্রুত হারে বেড়ে চলেছে। দেশে ডায়াবেটিস ও প্রি-ডায়াবেটিসের পাশাপাশি গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের (জিডিএম) হারও দ্রুত বাড়ছে। পরিসংখ্যান মতে, বাংলাদেশে গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের হার ১০-১৪ শতাংশ । দেশে ডায়াবেটিসের পাশাপাশি ডায়াবেটিসজনিত জটিলতা বিশেষ করে, পক্ষাঘাত, হৃদরোগ, পায়ে পচনশীল ক্ষত, অন্ধত্ব, কিডনির কার্যক্ষমতা লোপ পাওয়ার হার বাড়ছে। পাশাপাশি বাড়ছে মহিলাদের গর্ভকালীন ডায়াবেটিস, বেশি ওজনের শিশুর জন্ম ও জন্মের পরই শিশুর মৃত্যু, অকালে সন্তান প্রসব এবং শিশুদের জন্ম ত্রুটি বৃদ্ধির হারও। সেই সাথে এই সব জটিলতায় মাতৃমৃত্যুর হারও বাড়ছে। 


খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন বিশেষ করে, অধিক চিনি, তেল ও চর্বিযুক্ত খাবার, শারীরিক পরিশ্রমে অনীহা, মুটিয়ে যাওয়া, মানসিক চাপ, মাতৃত্বকালীন পুষ্টিহীনতাকে ডায়াবেটিসের অন্যতম ঝুঁকি হিসেবে দেখা হয়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, মাতৃত্বকালীন পুষ্টিহীনতার ফলে গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের পাশাপাশি কম ওজনের শিশু জন্ম নেবার ঝুঁকি যেমন বেড়ে যায়, তেমনি এইসব শিশুদের ভবিষ্যতে ডায়াবেটিস ও হৃদরোগে আক্রান্ত হবার ঝুঁকিও অনেকগুণ বেড়ে যায়। বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, যে-সব বিবাহিত মহিলা প্রি-কনসেপশন কাউন্সিলিং বা গর্ভধারণ-পূর্ব সেবা নিয়েছে অর্থাৎ গর্ভধারণের আগে রক্তে শর্করার পরিমাণ, রক্তচাপ, রক্তশূন্যতা, পুষ্টি অবস্থা, প্রস্রাবে আমিষ ও ইনফেকশন পরীক্ষা করে চিকিৎসকের পরামর্শমত যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছে, তাদের মধ্যে মাতৃত্বকালীন ও প্রসবকালীন জটিলতার হার অনেক কম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস সমিতির মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো গর্ভধারণ-পূর্ব পরামর্শ সেবা গ্রহণ এবং এর মাধ্যমে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হ্রাস করতে সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে কাজ করে যাচ্ছে। উদ্বেগের বিষয়, বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে এখনো গর্ভধারণ-পূর্ব পরামর্শ সেবা নেয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট সামাজিক সচেতনতা এখনো গড়ে ওঠেনি। 


পৃথিবীর প্রতিটি সমাজে ও ধর্মে ধর্মীয় নেতাদের (বিশেষ করে ইমাম ও পুরোহিতদের) যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়। ধর্মীয় নেতাদের সামাজিক প্রভাব বিবেচনা করে আফ্রিকা ও এশিয়ার বেশ কিছু দেশ ধর্মীয় নেতাদের মাধ্যমে জন্মনিয়ন্ত্রণ, এইডস, মা ও শিশুর  পুষ্টিহীনতা প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে কাজ করে যাচ্ছে। এসব দেশ ইতিমধ্যে এর সুফলও পেতে শুরু করেছে। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলিম এবং অন্যান্য দেশের মতো এখানেও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে ধর্মীয় নেতাদের যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়। মুসলিম বিয়েতে বিবাহ নিবন্ধন বাধ্যতামূলক এবং তা অবশ্যই একজন নিবন্ধিত কাজীর মাধ্যমে স্বীকৃত হতে হয়। বিয়েতে কাজীদের গুরুত্ব বিবেচনা করে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি (বাডাস) বিয়ের অনুষ্ঠানে কাজীদের মাধ্যমে নব-দম্পতিদের মধ্যে প্রি-কনসেপশন কাউন্সিলিং সেবা দেয়ার মাধ্যমে মাতৃত্বকালীন ও প্রসবকালীন জটিলতা, বিশেষ করে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস, মা ও শিশু মৃত্যুর হার কমিয়ে আনতে সামাজিক সচেতনতা বাড়ানোর জন্য দু’বছর মেয়াদি একটি বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা গ্রহণ করেছে।